দায়েমি সালাত


আত্মদর্শন উদ্দেশ্য শেরেক হইতে মুক্ত হইবার জন্য দায়েমি সালাত পালনের আহ্বান।সালাত বলিতেই দায়েমি সালাত বুঝায়। আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রসুলের সঙ্গে সংযোগ প্রচেষ্টার নাম সালাত। রসুলের সংযোগই আল্লাহ্‌র সংযোগ। এই সংযোগ অর্থাৎ সালাত যে ব্যক্তি পালন করে তাহাকে মুসল্লি বলে। মুসল্লির পরিচয় দিতে যাইয়া কোরানে বলা হইয়াছে সেই ব্যক্তি মুসল্লি, যে ব্যক্তি দায়েমি সালাত পালন করে (মুসল্লির সংজ্ঞা ও তাঁর পরিচয় দ্রষ্টব্য ৭০:২২-৩০,৩২-৩৫*1). ইহাও একটি কারণ যাহার জন্য কোরানে পাঁচ বা ছয়বারের ওয়াক্তিয়া সালাতের উল্লেখ নাই। কোরান মূলনীতি প্রকাশক। খণ্ড খণ্ড পাঁচবেলার নামাজ কোরানে অগ্রাহ্য। একটানা দায়েমি সালাতের নির্দেশ দান করা কোরানের লক্ষ্য।
কর্মই সালাতের উপদান। এই কারণে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলিয়াছেনঃ “সম্যক কর্ম সম্যক সময়ে যথাবিহিত সম্পাদনের নাম সালাত।” সকল কর্ম ও চিন্তাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাহার স্বরূপকে জ্ঞান দ্বারা বিস্তারিত দেখিবার নাম সালাত। কর্মকে যতই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করিয়া দেখা যায় ততই সালাতের গভীরতা আসে।
কর্মের উপর সালাত প্রয়োগ ব্যতীত মানুষের সকল কর্মই বিভ্রান্তিমূলক। মহানবী সর্বকর্মের উপর সালাত প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করিবার যে পদ্ধতি দান করিয়াছেন তাহা আত্মদর্শনের জন্য সহজতর এবং সুন্দর। এইরূপ সার্বজনীন সালাতের নির্দেশনায় কোরানে ভরপুর হইয়া আছে।

 আনুষ্ঠানিক ওয়াক্তিয়া সালাত হইল গুণ-কীর্তন, আর দায়েমি সালাত হইল জ্ঞানগুণ অর্জন।

রাসুলাল্লাহ বলেছেনঃ সালাত (বা ধ্যান) আমার পরম আনন্দ। Mediation my supreme pleasure. সালাতের মাধ্যমেই সাধক সিদ্ধিলাভ করে। তাই সালাত বিষয়টি তার নিত্যানন্দের বিষয়। বস্তুর মোহে সংযুক্ত আনন্দ ক্ষণস্থায়ী বা অনিত্য। সালাত সাধককে শিরিকমুক্ত করিয়া অনিত্যতা হইতে নিত্যতায় পৌঁছাইয়া দেয়। সালাত সার্বক্ষণিক, ইহা সর্ব অবস্থায় এবং সর্ব কর্মে প্রযোজ্য, ধ্যানভিত্তিক সাধনা। সার্বক্ষণিক সালাত যে করে তাঁহাকে মুসুল্লি বলে। মুসুল্লি শেরেকমুক্ত অবস্থায় থাকিবার কারণে নিত্যানন্দ উপভোগ করে।

                              সালাতের মূলনীতিকে জীবনে রূপায়িত করার ব্যবস্থা হিসাবে আনুষ্ঠানিক পাঁচবেলার বাধ্যতামূলক এবং ভোররাত্রের একবেলা তাগিদমূলক সালাত পালনের ব্যবস্থা রসুলুল্লাহ (আ.) দান করিয়া গিয়াছেন, যেন মানুষ তাহার সারাদিনের কর্মগুলিকে আল্লাহ্‌র এবাদতে রূপান্তরিত করিয়া তুলিতে পারে। মুসল্লি হওয়ার জন্য কোরান মজিদের দায়েমি সালাতের নির্দেশ দিতেছেন। কাজেই ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত না হইলে সরকারী কর্মচারীগণ দায়েমি সালাত পালন করিয়া মুসল্লি হইতে পারিবেন না। ইহার কারণ যে সময়টুকু তাহারা সরকারের কাজে লিপ্ত থাকিবে সেই সময়টুকু সালাতরূপে গণ্য হবে না। এবং তাহা আল্লাহ্‌র এবাদতরূপে গণ্য হয় না যতকাল সমগ্র কর্ম এবাদতরূপে গৃহীত না হয় ততকাল মুসল্লিরূপে এবং সৎকর্মশীল দাসরূপে আল্লাহ্‌ গ্রহণ করেন না।
এই জীব ও জড় জগতের উদ্ভাবনের মূল কারণই হইল মানুষ নামক জীবকে জীবের ঊর্ধ্বে করিয়া আল্লাহ্‌র শক্তিশালী স্তরের সহিত মিলাইয়া লওয়া। মানুষের মধ্যে দুইটি স্তর, যথাঃ জ্বীন ও ইনসান। পশু প্রবৃত্তির ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষ হইল জ্বীন পর্যায়ের। আর মোমিনের নিকট সমর্পণকারী ও মোমিনদের অনুসরণকারী মানুষ হইল ইনসান পর্যায়ের। এই উভয় প্রকার মানুষকে মোমিনগণ সালাত শিক্ষা দানের মাধ্যমে অবতার পর্যায়ে উন্নীতকরণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এই কার্য সমাধা করিবার জন্যই একটি ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র বানাইয়া লওয়ার প্রয়োজন, যাহাতে সালাতের শিক্ষা নির্বিঘ্নে দান করা যায়। নতুবা দুনিয়াদার মানুষ মমিনগনকে এবং তাঁহাদের অনুসারীগণকে আক্রমণ করিয়া মারিয়া ফেলে অথবা তাঁহাদের সালাত অনুশীলন কার্যক্রমকে কঠিন ও কষ্টসাধ্য করিয়া তুলে। তাই ইসলামী রাষ্ট্রে গঠনের মূল লক্ষ্যই হইল সালাত শিক্ষা দান করা। সালাত কর্ম যতক্ষণ দায়েমী না হয় ততক্ষণ একজন সাধকের মুক্তি আসে না।শুরুর পর্যায়ে সালাতকে দায়েমী করিবার জন্য একজন মানুষকে তাহার দৈনন্দিন বৈষয়িক কাজকর্ম বন্ধ রাখিয়া একজন মোমিন গুরুর নির্দেশমত ঘরে এবং মসজিদে বসিয়া সালাত প্রশিক্ষণ লইতে হয়। এই জন্যই নবী-রসুলগণ প্রতি সাতদিনের যেকোন একটি দিনকেই তাই সপ্তম দিবস হিসেবে গ্রহণ করা যাইতে পারে। রাষ্ট্রের সবাই এই নির্দিষ্ট দিনে নিজ নিজ মোমিন গুরুর নির্দেশমত সালাত শিক্ষায় অংশগ্রহণ করিলে সামাজিক কার্যক্রম অচল হইয়া যাইতে পারে, তাই কিছু লোক দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাইবে এবং তাহাদের জন্য সপ্তাহের অন্য কোন একটি দিন বৈষয়িক কাজকর্ম হইতে অব্যাহতি দিয়া দায়েমী সালাতের ব্যবস্থা করিতে হইবে।এইভাবে সপ্তাহের একটি দিনে যখন একটি মানুষ নিরবচ্ছিন্ন সালাত প্রশিক্ষণে আগাইয়া যায়, তখন ধীরে ধীরে ২৪ ঘণ্টার একটি দিনের পুরো ২৪ ঘণ্টাই সে নিরবচ্ছিন্নভাবে সালাতী হালে থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া যায়। ইহা সম্পন্ন হইলে সপ্তাহের অন্য ছয়টি দিনেও তাহার এই সালাতি হাল বিস্তার লাভ করে।এই পর্যায়ে তাহাকে আর বৈষয়িক কার্যক্রম হইতে বিরত হইবার প্রয়োজন হয় না; বরং তাহার উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, লেনদেন, ঘুম-জাগরণ ইত্যাদি সমস্ত কাজেই সালাত ক্রিয়া বিস্তার লাভ করিতে থাকে। এইভাবে একজন মানুষের জীবনে দায়েমী সালাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
গুরুকেন্দ্রিক সালাতের আত্মিক অনুশীলনের কথা কোরানে সর্বত্র পরিব্যক্ত আছে। সালাত প্রক্রিয়ার সাহায্যে জন্মান্তরবাদের পরিচয় জ্ঞান পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং বিষয়-দর্শনের উপর জ্ঞানচক্ষু উদিত হয় বা উন্মীলিত হয়। এই সকল কথা কোরানে সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করিলে কোরানের কোন দর্শন উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বস্তুবাদী অর্থের মধ্যে অসংখ্য আত্মবিরোধী ভাব এবং গরমিল বিদ্যমান।
*লা-মোকায় উত্তোরণের জন্য তথা মুক্তিকামী সাধকদের জন্য বা খাস করিয়া ইনসানের জন্য জ্ঞানীবাদী সালাত যথাযোগ্য। এবং ইনসান হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বা রহমান রূপী সম্যক গুরুর নিকট হইতে কোরানজ্ঞান বা গুরুজ্ঞান অর্জন পর্যন্ত গুরুবাদী সালাত বা ভক্তিবাদী সালাতই যথার্থ।

মানুষ স্বভাবতই সালাত বিরোধী। সালাত মস্তিষ্কের মধ্যে মহাশূন্যতা আনয়ন করে। বিপরীত দিকে শেরেক আনয়ন করে প্রাচুর্য এবং মনের বহুমুখী ধন সম্ভার, যাহা আপাতদৃষ্টিতে অধিক সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এই জন্য ইনসান জান্নাতমুখী হইতে ভালবাসে এবং গুণগ্রাম সহকারে নিজেকে জান্নাতের ধনে ধনীরূপে দেখে। মুক্তিলাভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। বিশ্বের সুসভ্য গুরুবাদী ইনসানগণ কল্যাণমুখী কিন্তু মুক্তিমুখী নয়, তথা জান্নাতমুখী কিন্তু লা-মুখী নয়। ইহা সালাতের বিরোধীতা বা সালাতের প্রতি অনীহা। 

*নিশ্চয় যে পবিত্র হইল, সে কল্যাণ লাভ-করিল,
এবং তাহার রবের সংযোগে আসিল---অতএব সে করিল সালাত। (সূরা আলাঃ১৪-১৫)

ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি কামিয়াব হইয়া গেল যে ব্যক্তি তাহার নফসকে আমিত্ব প্রকাশ হইতে পাক করিতে পারিল এবং ইহাদ্বারা সে তাহার রবের সংযোগে আসিয়া পড়িল। অতএব ইহাতে তাহার সালাত করা হইয়া গেল। সূরাটি মক্কি সূরা। মদিনায় হিজরতের পর আনুষ্ঠানিক সালাত আরম্ভ হইয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজকীয় তফসির গুলিতে আজও লেখা হয়ঃ "এবং সালাত করে অথবা পড়ে"। আরবি 'ফা' অর্থ সুতরাং, অতএব। তাহারা এখানে ইহার অর্থ 'এবং' লিখিয়া বুঝাইতে চাহেন যে, আনুষ্ঠানিক সালাতই হইল প্রকৃত এবং একমাত্র সালাত এবং তাহা আজীবন সবাইকে পড়িতে হইবে, এমনকি নবিকেও। ইহা 'এজিদি আওয়াজ' অর্থাৎ রাজকীয় ঘোষণা ব্যতীত আর কিছুই নয়। সত্যকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা হিসাবে এইগুলি এক একটি (Twisting of facts) মোড় মাত্র।এখানে উল্লেখিত 'রবের সংযোগ' বলিতে কি বুঝায়? মানুষ আল্লাহতে নিমজ্জিতও হয় না, সংযুক্তও হয় না। কামিয়াব ব্যক্তি রবের সেফাতের অংশীদার হইয়া রবের স্বভাব প্রাপ্ত হয়, তাই তিনি রবের 'পরিচয় পত্র' বা 'পরিচয় ‎বাহক'। রব সকল সেফাতের উৎস আর এহেন ব্যক্তি হইলেন তাঁহারই আংশিক সেফাত-প্রাপ্ত বা সেফাতের অধিকার প্রাপ্ত। ইহাতে রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সেফাতের দ্বারা সে জাগ্রতভাবে সম্পৃক্ত হইয়া উঠে।



*চক্ষু : ইহা দ্বারা আল্লাহর দাসগণ পান করেন : তাহারা ইহা সঞ্চালিত করেন এক একটি সঞ্চালন।  তাহারা দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন পরিপূর্ণতা এবং ভয় করেন সেই সময়টিকে যাহার মন্দ ব্যাপক (বা বিস্তৃত) হইয়া থাকে (৭৬:৬+৭) 
ব্যাখ্যা(৬+৭)- আপন মুর্শেদের চেহারা মোবারকের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া তাঁহা হইতে আপন চক্ষু দ্বারা প্রেম শরাব পান করিবার রীতি অনেক তরিকার মধ্যে ব্যবস্থা হিসাবে প্রচলিত আছে। অবশ্য নিছক বস্তুবাদী তরিকার মধ্যে ইহা থাকিবে না। তাহারা ইহাকে শেরেক বলিয়াই মনে করে।
আল্লাহর দাসগণ চক্ষু দ্বারা পান করিয়া পূণ্যবান হইয়া থাকেন। তাহারা পান করেন আপন কামেল মুর্শেদের চেহারার অমৃত সুধা। মুর্শেদের চেহারা ধ্যান করা আল্লাহর দাসত্বের প্রধান অঙ্গ। এই আমল দ্বারা যাহারা পূণ্যবান হইয়াছেন তাহারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন এক এক করিয়া আগমনকারী প্রত্যেকটি বিষয়ের উপরে। ইহাতে মোহকালিমা হইতে সকল বিষয় পরিশুদ্ধ হইয়া সৌন্দর্যমণ্ডিত হইয়া উঠে। বিষয়ের বিষমুক্ত হইয়া সকলই সুন্দরমধুময় হইয়া যায়।
এইরূপে তাহার দৃষ্টি দ্বারা অর্জন করেন জীবনের পরিপূর্ণতা। তাহারা ভয় করেন সেই সময়ের মন্দকে যাহা সংসার জীবনে সাধারণত ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। মানুষ জন্মলগ্ন হইতে সালাত কর্ম শুরু না করা পর্যন্ত সময়কে মন্দ সময় বলিয়া আখ্যায়িত করা হইয়াছে। কারণ, মানুষ এই সময় সালাতের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকে এবং বিষয় মোহের শিরিক দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে বিধায় সে পরিপূর্ণভাবে একজন মোশরেক এবং কাফের। সালাত কর্ম আরম্ভ না করা পর্যন্ত সময়ের মন্দ স্বরূপটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি করিতেই থাকে। এই কারণে সাধকগণ এই মন্দ সময়টিকে ভয় পান এইজন্য যে, পরজীবনে জ্ঞানী গুরুর সংস্পর্শে আসিবার সম্ভাবনা নাও থাকিতে পারে। কারণ, অর্জিত বিষয়মোহ এবং কুফুরী ক্রমবর্ধমান হইয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে গ্রাস করিয়া ফেলে।
*নিশ্চয় ইহাই তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী প্রতিদান এবং তোমাদিগের কর্মপ্রচেষ্টা ধন্যবাদ প্রাপ্ত (৭৬:২২) 
ব্যাখ্যাঃ সালাত কর্মের প্রয়োগ দ্বারা সাধকের ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি দ্বারপথে আগমনকারী বিষয়রাশি পবিত্র হইয়া যায় ----ইহাই চিরস্থায়ী প্রতিদান অর্থাৎ চিরস্থায়ী অর্জন; তখনই কেবল রব হইতে ধন্যবাদ প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জিত হয়।

৭০ঃ২৩.(মুসল্লি তাহারা) যাহারা তাহাদের সালাতের উপর চিরকাল সার্বক্ষণিকভাবে থাকে।
ব্যাখ্যাঃ সালাত যে করে তাহাকে মুসুল্লি বলে এবং মুসুল্লির কার্যক্রমকে সালাত বলে। মুসুল্লির সালাত ‘দায়েমি’ অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা পরিব্যপ্ত। সারাদিনের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তা যে-সমস্ত ধর্মরাশি ও সংস্কার মস্তিষ্কে উৎপন্ন করে তাহাদের গ্রহণ-বর্জন রসুলাল্লাহর নির্দেশিত ধারায় সুসম্পন্ন করিতে যত্নবান থাকে। অনুমোদনের বাইরে কিছুই করেন না।
টীকাভাষ্যঃ *1)
মুসল্লির চরিত্র (৭০:১৯-৩৫)

সালাতের ধ্যানের দ্বারাই কেবল মানুষ জীবন দর্শনের আদি-অন্ত দেখিয়া লইতে পারে। অতএব সকল যুগের কাফেরদের পরিণাম যে একই রূপ হইয়া থাকে ইহা কি লোকেরা দেহের ভিতরে ভ্রমণ করিয়া দেখিয়া লইবে না। সুতরাং জাহান্নামের শাস্তিও উপলব্ধি করিতে পারে না। এইজন্য কাফেরগণ তাহাদের পরিণাম সম্বন্ধে মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়। ইহা এইজন্য যে, আল্লাহ তা'লাই আমানুদের অভিভাবক বন্ধু রূপে তাহাদিগকে সালাতের প্রশিক্ষণ দিয়া জীবন দর্শনের (বা আত্মদর্শনের) জ্ঞান দানে সমৃদ্ধ করেন। এই সত্য অস্বীকার করিবার কারণে ইহা হইতে কাফেরগণ বঞ্চিত হইয়া থাকে।(দ্র. সূরা মোহাম্মদঃ১০+১১; কোরান দর্শন সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী।)

#‎সালাত, #‎সদকা ও #‎সাদেকঃ
সালাত ব্যতীত কেহই সত্যদ্রষ্টা হইতে পারে না। এবং সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ ব্যতীত কোরানের অনুরূপ বিবরণ কেহ আনিতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মহাসত্য নিহিত রহিয়াছে। কিন্তু সালাত ব্যতীত এই মহাসত্য আপন অন্তর হইতে আনয়ন করিয়া জনগণের নিকট পেশ করা সম্ভব নয়। সত্যদ্রষ্টা হওয়া অর্থ নফসের নিকট আগত ধর্মগুলি গুরুর নির্দেশ মত যথারীতি দর্শন করা। নফসের দ্রষ্টা না হইলে রবের দ্রষ্টা হয় না, কারণ নফসের দ্বারাই রব পরিবেষ্টিত হইয়া আছেন।সত্যের বাস্তব অনুভূতি, চরিত্রের মধ্যে সত্যকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করিবার নাম সদকা। পরিপূর্ণভাবে যিনি সদকা করেন অর্থাৎ মনের মধ্যে আগত ও প্রত্যাগত সকল দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, অনুভূতি, চিন্তা ইত্যাদি পরিপূর্ণভাবে প্রত্যক্ষ করেন তিনি সাদেক, অর্থাৎ সত্যদ্রষ্টা।
--- 

#‎সালাত ও #‎জাকাত
......................................
কোরানটাকে সালাতের পুস্তক বলা যাইতে পারে। কারণ কোরানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সালতেরই কথা বিধৃত হইয়া আছে। সালাত হইল দায়েমি, সার্বক্ষণিক। সালাতের মৌলিক কথা হইল আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়া মস্তিষ্ক নামক বিরাট একটা চেম্বারের মধ্যে যাহা কিছু আসিতেছে দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি নৈসর্গিক জগতের যাহা কিছু আসিতেছে সেইগুলি এক এক করিয়া দর্শন করা কি আসিতেছে? কোন একটা বিষয় সম্বন্ধে অনবরত না থাকা, অবনত থাকা to be conscious all everything that enters on brain through the seven entrynas. আমাদের সপ্ত ইন্দ্রিয়দ্বার দিয়া যাহা কিছু মস্তিষ্কে প্রবেশ করিতেছে তাহার প্রত্যেকটিকে এক এক করিয়া দর্শন করার নাম হইল সালাত। খুব কঠিন কাজ। এবং সালাত ঠিকমত হইলে উহার যে মোহ কাটিয়া যায় থাকে না উচ্ছেদ হইয়া যায় তাহাকে বলে জাকাত। জাকাত অর্থ উদ্বৃত্ত আয়ের আড়াই ভাগ ট্যাক্স দেওয়া গরিবকে দান করা মোটেই না, একটি জায়গায়ও দেখাইতে পারিবেন না কোরানে। সালাত এবং জাকাত মোসলমানের জীবনে সবচেয়ে বড় duty. যদি কেহ করিতে পারে তিনি মুক্ত হইয়া যায়............... ।-
.............................. 
"ধর্ম" অর্থ phenonmenon সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বার দিয়া যাহা কিছু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাহার সবকিছুকে ধর্ম বলে। ধর্মগুলির প্রতি মোহবিষ্ট হইয়া মস্তিষ্কে ধরিয়া রাখিলে সেগুলি মানুষকে সৃষ্টির সঙ্গে ধরিয়া রাখে। ইহাকে বলা হয় সংস্কার বা শিরিক। সুতারাং মনের মধ্য দিয়া আগমনকারী ধর্মসুমহের মোহ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং পরিত্যাজ্য। ধর্মের মোহ পরিত্যাগ করিবার অনুশীলনকে সালাত বলে। সিয়াম অর্থ ধর্ম পরিহার বা পরিত্যাগ। ...

‎মোত্তাকি, সালাত ও ‎রেজেকঃ-
*(তাহারাই মোত্তাকি) যাহারা গায়েবের সহিত ইমানের কাজ করে, সালাত দাঁড় করে এবং আমরা যে রেজেক দেই তাহা হইতে ব্যয় করে, (সূরা বাকারাঃ৩)

#‎ব্যাখ্যাঃ এই বাক্যে মোত্তাকির আমলের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। মোত্তাকি সেই ব্যক্তি যে অদৃশ্যের সহিত ইমানের কাজ করে অর্থাৎ সালাত দাঁড় করে। এখানে সালাত প্রক্রিয়ার স্বরূপ বর্ণনা করা হইতেছে। ইন্দ্রিয় দ্বারগুলি দ্বারা যাহা কিছু মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাহার অধিকাংশই অদৃশ্য বিষয়। এই অদৃশ্য বিষয়গুলি হইলঃ দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, কথা ও ভাব। এইগুলিকে এক এক করিয়া সঠিক দর্শন করিবার নাম সালাত। এইরূপ দর্শন করা বিষয়কেই বলা হইয়াছে গায়েবের সহিত ইমানের কাজ করা। এইরূপ সালাত ব্যতীত ইমানের কাজ সঠিক সম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়।আল্লাহর রেজেক বস্তুগত দান নয়। ইন্দ্রিয় দ্বার সমূহ দ্বারা যাহা কিছু আগমন করে তাহা কোরানে উল্লিখিত পদ্ধতিতে গ্রহণ করিবার মধ্যে আল্লাহর রেজেক নিহিত আছে। এবং এই পদ্ধতিতে মানুষ শের্কমুক্ত হইয়া আল্লাহর গুণে গুণাম্বিত হয়। ইহা আমানগণের সালাত। ইন্দ্রিয় দ্বারসমূহের মাধ্যমে যাহা কিছু ধর্মরূপে প্রবেশ করে তাহা উল্লেখিত পদ্ধতি অনুযায়ী গ্রহণ না করিলে তাহা হয় শের্ক এবং নফসানিয়াত। অপরপক্ষে সঠিক গ্রহণ করিলে তাহা হয় 'নফস দর্শন' বা আত্মদর্শন এবং ইহাই প্রকৃত সালাত।গায়েব অর্থ অদৃশ্য বিষয়। সপ্ত ইন্দ্রিয় দ্বারে যে ধর্মসমূহের আগমন হয় সেইগুলির প্রায় সকলই অদৃশ্য বিষয়। এইগুলি এক এক করিয়া সঠিক দেখা বা 'গণনা করা' কর্মকে সালাত বলে এবং ইহা ইমান অর্জন করিবার একটি বিশিষ্ট আমল। অদৃশ্যে বা অলক্ষ্যে আগমনকারী এই বিষয়সমূহ অর্থাৎ ধর্মসমূহ সঠিক দর্শন যাহারা করে তাহারা আল্লাহর রেজেক হইতে ব্যয় করিয়া ফেলে সংস্কাররূপে কিছুই মস্তিষ্কে জমা রাখে না।
 _____ সদর উদ্দিন আহ্‌মদ চিশতী; কোরান দর্শন। 

(দ্রষ্টব্য *https://www.youtube.com/watch?v=xJhXXASGzZk)

Comments

Popular Posts